প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। ১। মীরাস বন্টন হয় মৃত ব্যক্তির। কিন্তু জীবিত থাকা অবস্থায় পুরুষের কামাইয়ে বাবা-মা কত ভাগ অংশীদার আর স্ত্রি-সন্তান কত ভাগ প্রাপ্য? ২। শাশুড়ির সাথে ছেলেবৌর বনিবনা হয় না। দোষ দু’জনেরই আছে। এখন ফাসাদ এড়াতে ছেলেবৌ আলাদা বাসস্থান দাবি করা কি শরীয়ত সম্মত? শশুর-শাশুড়ির সাথে থাকা কতটা জরুরি? ৩। মা বাবা কামড়ে গোশ তুলে নিলেও উহ শব্দটুক না করা এই হাদীসের ভিত্তিতে, তারা যদি জুলুম করে তার প্রতিবাদ কি জবানে করা যাবে? ৪। ‘দুনিয়া তছনছ হয়ে গেলেও আমি আব্বু-আম্মুর (আব্বু সরকারি কর্মকর্তা, আম্মুর শারীরিক শক্তি এখনো অক্ষুণ্ণ) সাথে থাকবো। আম্মুর অত্যাচার সহ্য করে যদি তুমি তাদের সাথে থাকো তাহলে আমি তোমার দায়িত্ব নিবো অন্যথায় আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারবো না। ‘মাসে ২ লক্ষ+ টাকা কামাই করা ছেলে তার বৌকে এই কথা বলা শরীয়ত মোতাবেক কতটুক সঠিক?

উত্তর :

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ
১। পুরুষের ইনকামে স্ত্রী বা পিতামাতা নির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে অধিকারী হবেন বিষয়টা এমন নয়। বরং স্বামীর দায়িত্ব হল সর্বাবস্থায় (অর্থাৎ স্বামী সচ্ছল হোক বা অসচ্ছল) স্ত্রীকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণপোষণ দেওয়া। এটা স্বামীর উপর ওয়াজিব।
আর পিতামাতা যদি অসচ্ছল ও মুখাপেক্ষী হয় তবে সেক্ষেত্রে পিতামাতার ভরণপোষণও ওয়াজিব হয়ে যায়। পিতামাতা সচ্ছল হলে সন্তানের উপর তাদের ভরণপোষণ ওয়াজিব নয়। এক্ষেত্রে তারা তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে এবং তাদের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখবে। তাদের শরীয়তসম্মত আদেশ মেনে চলবে এবং যথাযথভাবে তাদের খেদমত করতে থাকবে। খেয়াল রাখবে তারা যেন কষ্ট না পায়।
উল্লেখ্য যে, স্ত্রীর ভরণপোষণ যথাযথভাবে আদায় করার পর স্বামী তার সম্পদ তার পিতামাতা বা অন্য কোন আত্মীয়ের পিছনে খরচ করলে স্ত্রীর আপত্তি না করা কর্তব্য। স্ত্রী দেখবে তার হক ঠিকমত আদায় করা হচ্ছে কিনা। কেননা পিতামাতা সচ্ছল হোক বা অসচ্ছল সন্তান সাধ্যমত তাদের পিছনে খরচ করবে এটাই সন্তানের দায়িত্ব ও স্বাভাবিক।- সূরা ইসরা, আয়াত ২৪; সূরা লুকমান, আয়াত ১৫; সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৩১০৪; রদ্দুল মুহতার ৩/৬২১-৬২৫; ইমদাদুল আহকাম ২/৮৮৯
২+৪। স্ত্রী যদি একান্নভুক্ত পরিবারে থাকতে না চায় তবে তাকে বাধ্য করা জায়েয নেই। এক্ষেত্রে স্বামীর উপর স্ত্রীর জন্য পৃথক ঘরের (অন্তত একটি কামরার) ব্যবস্থা করা ওয়াজিব। স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেক নারীই এ কামনা করবে যে, সে স্বামীকে নিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মত করে একটা সংসার গড়ে তুলবে। তার থাকার জন্য ভিন্ন একটি ঘর থাকবে যেখানে সে তার মালামাল সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে এবং স্বাধীনভাবে তার স্বামীর সাথে বিনোদন ও মনোরঞ্জন করতে পারবে। একান্নভুক্ত পরিবার অনেক ক্ষেত্রেই এ কামনায় বাঁধা সৃষ্টি করে। ফলে শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ, দেবর প্রমুখদের সাথে পুত্রবধূর বনিবনা হয়ে উঠে না। তাই সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে।
তাছাড়া আমাদের দেশে শাশুড়ী-পুত্রবধূর বৈরিভাব একটি চিরাচরিত নিয়ম। একদিক দিয়ে শাশুড়ী যেমন পুত্রবধকে মেয়ে মনে করতে পারে না অন্যদিক দিয়ে পুত্রবধূও শাশুড়ীকে মা মনে করতে পারে না। ফলে অশান্তির আগুন দিন দিন বাড়তে থাকে। যার খেসারত ছেলে বা স্বামীকেই দিতে হয়। এক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল দ্বীনী মূল্যবোধের অভাব। প্রত্যেকে যদি অপরের অধিকারের দিকে লক্ষ্য রাখতো তবে কোন সমস্যা হত না। কিন্ত প্রত্যেকে নিজের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত।
হযরত থানভী (রঃ) বলতেন, চুলার আগুন থেকেই সংসারের শান্তিতে আগুন লাগে, অতএব এই যুগে শুরু থেকেই চুলা পৃথক করে দেওয়া সমীচীন।
অনেক পিতা-মাতা ও সন্তান মনে করেন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার গড়ে উঠলে পিতা-মাতা অবহেলিত বা বঞ্চিত হবেন। এটা একটি ভুল ধারনা। সন্তানকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করলে এবং ভালভাবে গড়ে তুললে সন্তান পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে ত্রুটি করবে না ইংশাআল্লাহ। তাছাড়া জোর জবরদস্তি করে কিছুদিন একসাথে থাকলেও একদিন তো পৃথক হতেই হবে। কিন্ত তখন এমনভাবে পৃথক হবে যে কেউ কারো চেহারা দেখতে চাইবে না। তাই আগেভাগেই পৃথক হওয়া ভাল।
তবে প্রিয় দ্বীনী বোন, এই তো গেল ফাতওয়া। কিন্তু আপনার একথা মনে রাখা উচিত একজন মা যখন তিলেতিলে রক্ত পানি করে তার ছেলেকে মানুষ করার পরে তাকে বিবাহ দেয় এবং দুদিন পরেই যদি তার পুত্রবধূ আলাদা সংসারের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ছেলেকে মা-বাবা থেকে দূরে সরাতে চায় তবে আপনি বিষয়টিকে কীভাবে নিবেন? বিষয়টি দুদিন পর (আপনি মা হলে) হয়তোবা আপনিও মেনে নিতে পারবেন না। তাই শাশুড়িকে নিজের মা মনে করে কিছুটা ছাড় দিয়ে যদি একসাথে চলা যায় তবে ভালো। যদিও অনেকক্ষেত্রে তা কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে দুনিয়াবী ও দ্বীনী সমস্যার কারনে আপনি যদি একসাথে থাকতে না চান তবে আপনার স্বামীর জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা জরুরী। এমতাবস্থায় আপনার স্বামী মাতা-পিতার হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে যাবেন। এতে তারা প্রথমে একটু কষ্ট পেলেও তিনি যখন তাদের খেদমত চালিয়ে যাবেন এবং অর্থনৈতিক ভাবে তাদের সহযোগিতা করে যাবেন তারা সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন ইংশাআল্লাহ।-রদ্দুল মুহতার ৩/৫৯৯-৬০১; আল বাহরুর রায়েক ৪/৩২৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫৫৬; তোহফায়ে জাওযাইন
৩। প্রথম কথা হল প্রশ্নোক্ত বিষয়টি হাদীস নয়।
আর পিতামাতার সাথে তো প্রতিবাদ করা যায় না, তবে তারা স্ত্রীর কোন হক নষ্ট করলে বা তার উপর জুলুম করলে স্বামী তাদেরকে হেকমতের সাথে নরমভাবে কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝাবে। এটা তার কর্তব্য। এরপরেও তারা জুলুম অত্যাচার বন্ধ না করলে তখন স্ত্রীর জন্য স্বামীর পৃথক ব্যবস্থা করা কর্তব্য।

Loading