প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম হযরত আমার প্রশ্ন গুলো হলো: ১/মৃত ব্যক্তির গোসল পদ্ধতি কেমন হবে নারী ও পুরুষ এর? কয়জন গোসলের সময় থাকবে? গোসল যারা করিয়ে টাকা দেওয়া কি জায়েয? ২/কবরে পুরুষ/মহিলার দাফন এর পদ্ধতি কেমন হবে? কয়জন নিচে নামবে? কিভাবে কবর দিবে? ৩/মৃত ব্যক্তির কাফন এর কাপড় পড়ানোর পদ্ধতি কেমন? জাযাকাল্লাহু খায়রন ফিদ দারাইন।

উত্তর :

ওয়া আলাইকুমুস সালাম

(১) মায়্যিতকে গোসল দেওয়ার সময় যতজন প্রয়োজন থাকতে পারে। মায়্যিতকে ফ্রি গোসল করিয়ে দেওয়া উত্তম। তবে প্রয়োজনে কেউ বিনিময় নিতে চাইলে নিতে পারে।-আদ্দুররুল মুখতার ২/১৯৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫৯।

মায়্যিতকে (পুরুষ ও মহিলার) গোসল করানোর পদ্ধতি নিম্নরূপ-

ক. মায়্যিতকে খাটিয়ার উপর শুইয়ে তার নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত মোটা কাপড় দ্বারা ঢেকে তার পরিধানের সব কাপড় খুলে দিবে।

খ. তারপর হাতে কাপড় পেচিয়ে ৩/ ৫ ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করিয়ে ঐ স্থান ধৌত করে দিবে।

গ. তারপর নাকে, মুখে, কানে তুলা দিয়ে উযু করাবে। তবে মুখে ও নাকে পানি প্রবেশ করাবে না। প্রথমে চেহারা তারপর কনুই সহ দু’হাত ধোয়াবে, অতঃপর মাথা মাসেহ করিয়ে উভয় পা ধোয়াবে।

ঘ. গোলাপ, সাবান বা এ জাতীয় জিনিস দ্বারা মাথা ধোয়াবে।

ঙ. মায়্যিতকে বাম কাঁতে শয়ন করিয়ে শরীরের ডান পাশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বরই পাতা মিশ্রিত হালকা গরম পানি তিনবার এমনভাবে ঢেলে গোসল করাবে যাতে পানি বাম পাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অতঃপর ডান কাঁতে শয়ন করিয়ে শরীরের বাম পাশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগের নিয়মে তিনবার ধোয়াবে।

চ. অতঃপর মায়্যিতকে নিজের শরীরের সাথে ঠেস লাগিয়ে কিঞ্চিত বসিয়ে হালকাভাবে পেটের উপর থেকে নিচের দিকে মালিশ করবে। তারপর কাপড় পেচানো হাতে ইস্তিঞ্জার জায়গা মুছে ফেলে প্রয়োজনে ধুয়ে দিবে। উল্লেখ্য যে, এতে উযু গোসলের কোন ক্ষতি হবে না।

ছ. অতঃপর মায়্যিতকে আরেকবার বাম কাঁতে শয়ন করিয়ে কর্পূর মিশানো পানি শরীরের ডান পাশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনবার এমনভাবে ঢালবে যেন বাম পাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অনুরুপভাবে অপরদিকেও ঢালবে।

জ. এরপর শুকনো কাপড় দ্বারা সমস্ত শরীর ভালভাবে মুছে দিবে।

ঝ. মায়্যিতকে কাফনের উপর রাখার পর তার নাক-কানের তুলা বের করে ফেলবে, অতঃপর তার মাথায় এবং পুরুষ হলে দাঁড়িতেও আতর লাগিয়ে দিবে। কাফনের কাপড়ে আতর লাগাবে না বা তুলায় লাগিয়ে মায়্যিতের কানে ঢুকাবে না। তাছাড়া কপালে, নাকে, উভয় হাতের তালুতে, উভয় হাঁটুতে এবং পায়ে কর্পূর লাগিয়ে দিবে।

ঞ. মায়্যিতের পশম, মোচ, চুল, নখ কাটবে না এবং তার চুল আচঁড়াবে না। যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় রেখে দিবে। গোসল শেষে কাফন পরিয়ে অতিসত্বর জানাযা নামাযের ব্যবস্থা করবে।

 

(২) কবরে মায়্যিতের দাফন পদ্ধতি নিম্নরূপ-

(ক) কোন অসুবিধা না থাকলে মুর্দার খাট কবরের পশ্চিম পাশে রাখবে এবং সেখান থেকেই মুর্দাকে কবরে নামাবে। সাধারণত দুজন হলে নামান সুবিধা হয়। আর অসুবিধা থাকলে খাটিয়া যে দিকে রেখে লাশ কবরে নামানো সুবিধা হয়, সেদিক দিয়েই তাকে কবরে নামাবে।

(খ) কবরে নামানোর পর- بسم الله وعلى ملة رسول لله বলে মুর্দাকে সম্পূর্ণ ডান কাঁতে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। এটাই সুন্নাত তরীকা।

উল্লেখিত দু‘আর মধ্যে এভাবে শোয়ানোর কথা ঘোষণা করা হলেও আফসোসের কথা হল , মুখে তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরীকায় শোয়ানোর কথা স্বীকার করা হয় অথচ কাজ করা হয় তার সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ মুর্দাকে চিৎ করে কবরে এমনভাবে শোয়ানো হয়, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে শিক্ষা দেননি। সুতরাং মুখের কথার মধ্যে আর কাজের মধ্যে কোন মিল হয় না। এ ব্যপারে শরীআতের মাসআলা হল, জীবিত মানুষ যেভাবে সুন্নাত তরীকায় ডান কাতে শয়ন করে, মুর্দাকে সেভাবে কবরে ডান কাঁতে শোয়ানো সুন্নাত। চিৎ করে শোয়ানো এবং ঘাড় মুচড়িয়ে চেহারাটাকে কোন রকমে কিবলামুখী করা শরীআত সম্মত নয়। বরং সম্পূর্ণ ডান কাঁতে শোয়াবে, যাতে স্বাভাবিকভাবে চেহারা কিবলামুখী হয়ে যায়। এ জন্য কোন বিজ্ঞ আলেম বা মুফতী সাহেবের নিকট থেকে কবর খননের নিয়ম শিখে নেয়া দরকার যাতে ডান কাঁতে শোয়ালে লাশ কোনো দিকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। এ মাসআলাটি  ব্যপকভাবে প্রচার করা কর্তব্য যাতে সকল মুসলমানকে কবরে সহীহ তরীকায় রাখা হয়।

শরী‘আতের দৃষ্টিতে সীনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সীনার মধ্যে থাকে কলব বা অন্তর। আর কলবের মধ্যেই থাকে ঈমান। সুতরাং সীনাকে কিবলামুখী করে রাখা উচিৎ। সীনা এত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে নামাযে মুখ ঘুরে গেলে নামায মাকরূহ হয়, কিন্তু নামায ভঙ্গ হয় না; অথচ সীনা ঘুরে গেলে নামায ভঙ্গ হয়ে যায়। সুতরাং ভারতবর্ষে সীনা আসমানের দিকে রেখে চিৎ করে শুইয়ে দাফন করার যে গলদ তরীকা চালু হয়ে গেছে তার আশু অবসান হওয়া জরুরী।

(গ) যারা দাফনের কাজে অংশ নিবে, সম্ভব হলে তারা মৃত ব্যক্তির মাথার দিকে ডান হাত দিয়ে তিনবার মাটি দিবে। প্রথমবার মাটি দেয়ার সময় পড়বে منھا خلقناكم দ্বিতীয়বার মাটি দেয়ার সময় পড়বে- وفیھا نعیدكم আর তৃতীয়বার মাটি দেয়ার সময় পড়বে- وفیھا نخرجكم تارة اخرى

(ঘ) দাফন শেষে মৃত ব্যক্তির মাথার নিকট সূরা বাকারার শুরু থেকে مفلحون পর্যন্ত এবং পায়ের নিকট দাঁড়িয়ে ঐ সূরার শেষ দইু আয়াত অর্থাৎ امن الرسول থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বে।

(ঙ) সম্ভব হলে বেশি আপনজনেরা দাফনের পর কবরের পাশে আরো ঘণ্টাখানেক অবস্থান করবে এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আয় রত থাকবে যাতে মুনকার-নাকীরের সম্মুখে তার প্রশ্নোত্তর সহজ হয়।

(চ) দাফনের কাজ শেষ হওয়ার পর সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস এবং দুরুদ শরীফ ইত্যাদি পড়ে মায়্যিতের জন্য ছাওয়াব রেসানী এবং সকলে মিলে দুআ করতে পারে।

– সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ২৮৭৭; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং ৭৬৬৬; রদ্দুল মুহতার ৩/ ১৩৯, ২/১৯৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/ ২৩৭, ২/২৩৫; হিদায়া ১/১৭৯ ইমদাদুল মুফতীন-৪৪৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/ ২২৩; আহকামে মায়্যিত ৮৯, ২৩৬, ৩৯, ৪০; ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/ ৪৮৫।

 

(৩) পুরুষের কাফনে তিনটা কাপড় হওয়া সুন্নাত। যথাঃ (ক) ইজারঃ এটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা হবে।(খ) লেফাফা/চাদরঃ এটা ইজার থেকে ৪ গিরা (৯ ইঞ্চি) লম্বা হয়। (গ) কুর্তা/জামাঃ (হাতা ও কল্লী বিহীন) এটা গর্দান থেকে পা পর্যন্ত লম্বা হয়।

আর মহিলার কাফনে পাঁচটি কাপড় হওয়া সুন্নাত। উপরোক্ত ৩টির সাথে এই দুটি- (ক) সীনা বন্দঃ এটা বগল থেকে রান পর্যন্ত হওয়া উত্তম। নাভি পর্যন্ত হলেও চলবে।(খ) সারবন্দ/উড়নাঃ এটা তিনহাত লম্বা হয়।

কাফনের কাপড় পরিধান করানোর নিয়মঃ

প্রথমে কাফনের কাপড়ে তিন, পাঁচ বা সাতবার আগরবাতি ইত্যাদির ধোঁয়া দিবে। তারপর প্রথমে লেফাফা বিছাবে, তার উপর ইজার তার উপর জামার নীচের অর্ধাংশ বিছাবে এবং অপর অর্ধাংশ মাথার দিকে গুটিয়ে রাখবে। তারপর মায়্যিতকে এই বিছানো কাফনের উপর চিতকরে শোয়াবে। জামার গুটানো অর্ধাংশ মাথার উপর দিয়ে পায়ের দিকে এমনভাবে টেনে আনবে যেন জামার ছিদ্র (গলা) মায়্যিতের গলায় আসে যায়। এরপর গোসলের সময় মায়্যিতকে যে কাপড় পরানো হয়েছিল সেটা বের করে নিবে এবং নাক, কান ও মুখ থেকে তুলা বের করে নিবে।তারপর মাথা ও দাড়িতে খুশবু লাগাবে। অতঃপর কপাল, নাক, উভয় হাতের তালু, উভয় হাঁটু ও উভয় পায়ে (সিজদার অঙ্গসমূহে) কর্পূর লাগাবে। তারপর ইজারের বাম পাশ উঠাবে অতঃপর ডান পাশ উঠাবে । অর্থাৎ ডান পাশ উপরে থাকবে।অনুরূপভাবে  লেফাফার বাম পাশ আগে উঠাবে অতঃপর ডান পাশ। অতঃপর কাপড়ের লম্বা টুকরা বা সুতা দিয়ে মাথা এবং পায়ের দিকে এবং মধ্যখানে (কোমরের নীচে) বেঁধে দিবে।

আর মহিলাদের ক্ষেত্রে  প্রথমে লেফাফা বিছাবে, তার উপর ইজার, তার উপর সীনাবন্দ, তার উপর জামার নীচের অর্ধাংশ বিছাবে এবং অপর অর্ধাংশ মাথার দিকে গুটিয়ে রাখবে।তারপর মায়্যিতকে এই বিছানো কাফনের উপর চিতকরে শোয়াবে। অতঃপর পূর্বে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে জামা পরিধান করিয়ে গোসলের সময় মায়্যিতকে যে কাপড় পরানো হয়েছিল সেটা বের করে নিবে এবং নাক, কান ও মুখ থেকে তুলা বের করে নিবে।তারপর মাথা ও দাড়িতে খুশবু লাগাবে। অতঃপর কপাল, নাক, উভয় হাতের তালু, উভয় হাঁটু ও উভয় পায়ে (সিজদার অঙ্গসমূহে) কর্পূর লাগাবে।অতঃপর মাথার চুল দুই ভাগ করে জামার উপর সীনার পরে রেখে দিবে। একভাগ ডানদিকে অন্য ভাগ বামদিকে। এরপর উড়না মাথা ও চুলের উপর না বেঁধে বা না পেঁচিয়ে রেখে দিবে। অতঃপর সীনাবন্দ বগলের নীচ দিয়ে প্রথমে বামদিক অতঃপর ডানদিক জড়াবে। এরপর ইজারের বাম পাশ অতঃপর ডান পাশ এমনভাবে উঠাবে যেন সারবন্দ তার ভিতরে আসে যায়। অনুরূপভাবে  লেফাফার বাম পাশ আগে উঠাবে অতঃপর ডান পাশ। অতঃপর পূর্বোক্ত নিয়মে তিনস্থানে বেঁধে দিবে।

-সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং ১৮৯৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩১৫৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/২০২, ২০৪; আল বাহরুর রায়েক ২/৩০৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪০; হালবিয়ে কাবীর, পৃষ্ঠা ৫৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬০।

Loading