প্রশ্ন : আমি একজন কবি। এবং মনে প্রাণে ইসলাম বিশ্বাস করি। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কবিতা আমি লিখেছি। বিষয়বস্তু বলতে গেলে- প্রেম, দুঃখ-বেদনা, হতাশা, অস্থিরতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রত্যায়ে এবং কিছু ইসলামিক সহ আরো অন্যান্য… কুরআন সম্মন্ধে আমার তেমন জ্ঞান নেই। যতদূর শুনেছি- কবি ও কবিতা সম্পর্কে কুরআনের একটি বা কয়েকটি আয়াত আছে। এবং সেখানে নাকি কবিদের নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। সঠিক ব্যখ্যা জানতে চাই? অবশ্যই সূত্র মোতাবেক। ধন্যবাদ

উত্তর :

আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ (224) أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ (225) وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ (226) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا وَانْتَصَرُوا مِنْ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ (227)
অর্থঃ আর কবিগণ- তাদের অনুগামী তো হয় যতসব বিপদগামী লোক। তুমি কি দেখনি তারা প্রত্যেক উপত্যকায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়? আর তারা এমন সব কথা বলে যা নিজেরা করে না। তবে সেই সকল লোক লোক ব্যতিক্রম যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, আল্লাহকে বেশি পরিমানে স্মরণ করেছে এবং নিজেরা নির্যাতিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহন করেছে। যারা জুলুম করেছে তারা অচিরেই জানতে পারবে কোন পরিণামের দিকে ফিরে যাচ্ছে।–সূরা শুআরা, আয়াত ২২৪-২২৭
উক্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম মুফতী শফী (রহঃ) বলেন-
“আলোচ্য আয়াতে কবিতার পারিভাষিক ও প্রসিদ্ধ অর্থই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা ওজনবিশিষ্ট ও সমিল শব্দযুক্ত বাক্যাবলী রচনা করে, আয়াতে তাদের সমালোচনা করা হয়েছে। রেওয়ায়েত এই যে, এই আয়াত নাযিল হবার পর হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা, হাসসান ইবনে সাবেত, কাব ইবনে মালেক প্রমুখ সাহাবী কবি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে উপস্থিত হন এবং আরয করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আল্লাহ্ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেছেন। আমরাও তো কবিতা রচনা করি। এখন আমাদের কি উপায়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আয়াতের শেষাংশে পাঠ কর। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লেখিত ব্যতিক্রমীদের শামিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তফসীরকারগণ বলেছেন, আয়াতের প্রথমাংশে মুশরেক কবিদেরকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, পথভ্রষ্ট লোক, অবাধ্য শয়তান ও উদ্ধত জিন তাদেরই কবিতার অনুসরণ করত এবং তা বর্ণনা করত।-(ফতহুল বারী)।

ইসলামী শরীয়তে কাব্যচর্চার মানঃ উল্লেখিত আয়াতের প্রথমাংশ থেকে কার্বচর্চার কঠোর নিন্দা এবং তা আল্লাহ্ তাআলার কাছে অপছন্দনীয় হওয়া বোঝা যায়। কিন্তু শেষাংশে যে ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কাব্যচর্চা সর্বাবস্থায় মন্দ নয়; বরং যে কবিতায় আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করা হয় কিংবা আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে বিরত রাখা হয় অথবা অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তির নিন্দা ও অবমাননা করা হয় অথবা যে কবিতা অশ্লীল ও অশ্লীলতার প্রেরণাদাতা, সেই কবিতাই নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে যেসব কবিতা গোনাহ্ ও অপছন্দনীয় বিষয়াদি থেকে পবিত্র সেগুলোকে আল্লাহ তাআলা إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ আয়াতের মাধ্যমে ব্যতিক্রমভুক্ত করে দিয়েছেন। কোন কোন কবিতা তো জ্ঞানগর্ভ বিষয়বস্তু ও ওয়াজ ও উপদেশ সম্বলিত হওয়ার কারণে এবাদত ও ছাওয়াবের অন্তভুক্ত। হযরত উবাই ইবনে কাবের রেওয়ায়েত আছে, ان من الشعر حكمة অর্থাৎ কতক কবিতা জ্ঞানগর্ভ হয়ে থাকে।- (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৬১৪৫) হাফেয ইবনে হাজার বলেন, এই রেওয়ায়েতে ‘হেকমত’ বলে সত্যভাষণ বোঝানো হয়েছে। ইবনে বাত্তাল বলেন, যে কবিতায় আল্লাহ্ তাআলার একত্ব, তাঁর যিকর এবং ইসলামের প্রতি ভালবাসা বর্ণিত হয়, সেই কবিতা কাম্য ও প্রশংসনীয়। উপরোক্ত হাদীসে এরূপ কবিতাই বোঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে যে কবিতায় মিথ্যা ও অশ্লীল বর্ণনা থাকে, তা নিন্দনীয়। এর আরও সমর্থন নিম্ন বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ থেকে পাওয়া যায়। (১) ওমর ইবনে শারীদ তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার মুখ থেকে উমাইয়া ইবনে আবু সলতের একশ’ লাইন পর্যন্ত কবিতা শ্রবণ করেন। (২) মুতারিক বলেন, আমি কুফা থেকে বসরা পর্যন্ত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) এর সাথে সফর করেছি। প্রতি মনযিলেই তিনি কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। (৩) তাবারী প্রধান প্রধান সাহাবী ও তাবেয়ী সম্পর্কে বলেন যে, তাঁরা কবিতা রচনা করতেন, শুনতেন এবং শোনাতেন। (৪) ইমাম বুখারী বলেন, হযরত আয়েশা (রাঃ) কবিতা বলতেন। (৫) আবু ইয়ালা ইবনে ওমর থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্তি বর্ণনা করেন যে, কবিতার বিষয়বস্তু উত্তম ও উপকারী হলে কবিতা ভাল এবং বিষয়বস্তু মন্দ ও গোনাহের হলে কবিতা মন্দ। (ফাতহুল বারী)
তাফসীরে কুরতুবীতে আছে, মদীনা মুনাওয়ারার দশ জন জ্ঞান-গরিমায় সেরা ফেকাহ্বিশারদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে ওতবা ইবনে মাসউদ প্রসিদ্ধ সৃজনশীল কবি ছিলেন। কাযী যুবায়র ইবনে বাক্কারের কবিতাসমূহ একটি ¯^তন্ত্র গ্রন্থে সংরক্ষিত ছিল। কুরতুবী আবু আমরের উক্তি বর্ণনা করেন যে, উৎকৃষ্ট বিষয়বস্তু সম্বলিত কবিতাকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউ মন্দ বলতে পারেন না। কেননা, ধর্মীয় ব্যাপারে অনুসৃত প্রধান সাহাবিগণের মধ্যে কেউ এমন ছিলেন না, যিনি কবিতা রচনা করেননি অথবা অপরের কবিতা আবৃত্তি করেননি কিংবা শোনেননি ও পছন্দ করেননি।
যেসব রেওয়ায়েতে কাব্যচর্চার নিন্দা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ্ তাআলার স্মরণ, এবাদত ও কুরআন থেকে গাফেল হয়ে কাব্যচর্চায় নিমগ্ন হওয়া নিন্দনীয়। ইমাম বুখারী একে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন এবং তাতে হযরত আবু হুরাইরার এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন-
“পুঁজ দ্বারা পেট ভর্তি করা কবিতা দ্বারা ভর্তি করার চাইতে উত্তম”। ইমাম বুখারী বলেন, আমার মতে এর অর্থ এই যে, কবিতা আল্লাহ তাআলার স্মরণ, কোরআন ও জ্ঞানচর্চার উপর প্রবল হয়ে গেলে তা মন্দ এবং পরাভুত থাকলে মন্দ নয়। এমনিভাবে যেসব কবিতা অশ্লীল বিষয়বস্তু, অপরের প্রতি ভৎসনা, বিদ্রুপ অথবা অন্য কোন শরীয়ত-বিরোধী বিষয়বস্তু সম্বলিত হয়, সেগুলো সর্বসম্মতিক্রমে হারাম ও না-জায়েয। এটা শুধু কবিতার বেলায়ই নয়, গদ্যে এমনি ধরনের বিষয়বস্তু বিবৃত হলে তাও হারাম।- (কুরতুবী)
খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) প্রশাসক আদী ইবনে নযলাকে অশ্লীল কবিতা বলার অপরাধে পদচ্যুত করে দেন। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) আমর ইবনে রবীয়া ও আবুল আহ্ওয়াসকে এই একই অপরাধে দেশান্তরিত করার আদেশ দেন। অতঃপর আমর ইবনে রবীয়া তাওবা করলে তা গ্রহণ করা হয়।- (কুরতুবী)
যে জ্ঞান ও শাস্ত্র আল্লাহ্ তাআলা ও পরকাল থেকে মানুষকে গাফেল করে দেয়, তা নিন্দনীয়ঃ ইবনে আবী জমরাহ বলেন, যে জ্ঞান ও শাস্ত্র অন্তরকে কঠোর করে দেয়, আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে বিমুখ করে এবং বিশ্বাসে সন্দেহ, সংশয় ও আত্মিক রোগ সৃষ্টি করে, তার বিধানও নিন্দনীয় কবিতার অনুরূপঃ-তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৯৮৬, ৯৮৭ (সংক্ষিপ্ত)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনার প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। সারকথা, অসার, অন্তঃসারশূন্য, অশালীন, প্রেম, যৌন উসকানিমূলক এবং ইসলামী চেতনা বিরোধী কবিতা থেকে বিরত থাকবেন। আর এর প্রতি এত আসক্ত না হওয়া যাতে নামাযসহ অন্যান্য ইবাদত বন্দেগীতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।

Loading