প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম যাকাত সংক্রান্ত প্রশ্ন: এক ব্যক্তির কাছে ৭ ভরি (তোলা) স্বর্ণ আছে এবং এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। যাকাতের নেসাব হতে পারে এরকম আর কোনো সম্পদ (টাকা/ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি) তার কিছুই নেই। ৭ ভরি স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা (ক্যারেটের উপর নির্ভরশীল)। আমরা জানি এই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়; বরং সে যাকাত / ফিতরা / সদকা ইত্যাদি নিতে পারবে। স্পষ্টতই শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সে দরিদ্র, ধনী নয়। অপর ব্যক্তির সাড়ে বায়ান্ন ভরি (তোলা) রুপা আছে এবং এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। যাকাতের নেসাব হতে পারে এরকম আর কোনো সম্পদ (টাকা/ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি) তার নেই। সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় মাত্র ৪৫ হাজার টাকা। আমরা জানি এই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ; সে যাকাত / ফিতরা / সদকা ইত্যাদি নিতে পারবে না। স্পষ্টতই শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সে ধনী। আমার প্রশ্ন হলো, ক) এক ব্যক্তি তিন লক্ষ টাকার উপরে মালিক হওয়ার পরও সে যাকাত দিবে না, আর দ্বিতীয় ব্যক্তি মাত্র ৪৫ হাজার টাকার মালিক বলে সে ধনী বলে বিবেচিত হবে এবং তার উপর গরিবের হক্ব কায়েম হয়ে যাবে এর ব্যাখ্যা কি? খ) ইসলামের সর্বময় ইনসাফের সাথে এই নিয়ম কেন সাংঘর্ষিক হবে না ? গ) প্রিয় নবীর জীবদ্দশায় বেশি সম্পদের মালিক হয়েও যাকাত দেয়নি, আর অল্প সম্পদের মালিক হয়েও তার যাকাত দিতে হয়েছে এমন কোনো সহীহ ঘটনা আছে কিনা ? আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।

উত্তর :

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহ্তুমাল্লাহ

রমযানে দ্বীনী সফরে বাইরে থাকা,নিজের অসুস্থতা,বাচ্চাদের অসুস্থতা এবং মাদ্রাসার ব্যস্ততা সব মিলিয়ে উত্তর দিতে কিছুটা বিলম্ব হওয়াতে দুঃখিত। ভবিষ্যতে সময়মত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব ইংশাআল্লাহ।

ধনী দুই প্রকার। এক. যার যাকাতের নেসাব পরিমান মাল রয়েছে। এমন লোক যাকাত আদায় করবে। দুই. যার উপর যাকাত ওয়াজিব হয়নি বটে তবে তার প্রয়োজন অতিরিক্ত এমন সম্পদ রয়েছে যার মুল্য যাকাতের নেসাবের মুল্য সমপরিমান। এমন লোকের উপর যাকাত ওয়াজিব নয় তবে ছদকায়ে ফেতর ও কুরবানী ওয়াজিব। উপরোক্ত দুই প্রকার ধনীকেই যাকাত দেওয়া জায়েয নেই।

সুতরাং নেসাবও দুই প্রকার। একটি যাকাত ফরজ হবার নেসাব অন্যটি কুরবানী ও ফেতরা ওয়াজিব হবার নেসাব। উভয় নেসাবের মালিক যাকাত গ্রহন করতে পারবে না। প্রথম নেসাব নির্ধারণ হয় শুধুমাত্র যাকাতযোগ্য চারটি সম্পদ তথা সোনা,রুপা,টাকা-পয়সা ও ব্যবসার মাল দ্বারা। আর দ্বিতীয় নেসাব তথা কুরবানী ও ফেতরার নেসাব নির্ধারণ হয় প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ দ্বারা।

কাজেই কারো সাত তোলা স্বর্ণ থাকলে তিনি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে গরীব সাব্যস্ত হবেন বিষয়টি এমন নয়। বরং যার সাত তোলা পরিমাণ স্বর্ণ থাকে সাধারণত তার প্রয়োজন অতিরিক্ত কিছু সম্পদও( যেমন অতিরিক্ত জমি যা তার বসবাস ও জীবিকায় কাজে লাগে না বা অতিরিক্ত শাড়ি বা হাঁড়ি পাতিল যেগুলো সারা বছরে প্রয়োজন হয় না ) থেকে থাকে। সেমতে তিনি ধনীই হবেন। হ্যাঁ, তার যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত কোন সম্পদ না থাকে তবে তিনি গরীব-ই থেকে যাবেন।

এবার আসি প্রশ্নের মূল প্রসঙ্গে।

(ক) প্রশ্ন দেখে মনে হয় আপনি অনেকটা যৌক্তিকভাবে বিষয়টি বুঝতে চাচ্ছেন। প্রথমেই একথা স্মরণ রাখা দরকার সৃষ্টিকর্তা( আল্লাহ্‌) এবং সৃষ্টি (জিন,ইনসান) উভয়ের বুদ্ধি কখনও এক হতে পারে না। আর আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতিটি হুকুমের যৌক্তিক অবস্থান বান্দার পক্ষে অনুধাবন করা কখনও সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনের কারীমের শুরুতেই বান্দার অপারগতা, সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা তুলে ধরেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা ইরশাদ করেন الم (সূরা বাকারাহ, আয়াত ০১)।

সমস্ত মুফাসসিরীন এ বিষয়ে একমত যে, এ আয়াতের সর্বোত্তম তাফসীর হল “আল্লাহ্‌ তাআলা এর অর্থ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত”।

আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর অন্যতম বৈশিষ্ট হল যুক্তির পিছনে না পড়ে সমস্ত হুকুম আহকামকে বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া।এ বিষয়ে হযরত আলী (রাঃ) এর প্রসিদ্ধ বানী রয়েছে যা সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে বাইহাকী, সুনানে দারাকুতনী ও মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা সহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে সহীহ সনদে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ عَلِىٍّ قَالَ : لَوْ كَانَ الدِّينُ بِالرَّأْىِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ ، وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ

অর্থঃ হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দ্বীন যদি যুক্তির নিরিখে অনুধাবন করা যেত তবে (চামড়ার ) মোজার নিচের অংশ মাসেহ করার অধিক উপযুক্ত হত উপরের অংশ হতে( কেননা ময়লা লাগলে নিচের অংশেই লেগে থাকে উপরে নয়)। অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি মোজার উপরের অংশে মাসেহ করতে।- সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৬২।

মেশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাতুল মাফাতীহতে মোল্লা আলী কারী (রহঃ) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-

“পরিপূর্ণ আকল (বিবেক) শরীয়াতের অনুগামী হয়। কেননা তা ইলাহী হুকুমের রহস্য উদঘাটনে অক্ষম। কাজেই গোলামিত্তের চাহিদা অনুযায়ী তার উপর শুধুমাত্র হুকুম পালন করা  জরুরী। স্বেচ্ছাচারী, বিদআতী, পণ্ডিত এবং কাফেরদের মধ্য থেকে যারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা কুরআন ও হাদীস ছেড়ে কেবল যুক্তির পিছনে পড়ার কারনেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। আবূ হানীফাহ (রহঃ) বলেন, যদি আমি (কুরআন ও হাদীস ছেড়ে) যুক্তির আলোকে কথা বলতাম তবে পেশাব করার কারনে গোসলকে ফরজ করে দিতাম। কেননা তা সর্বসম্মতিক্রমে নাপাক। আর বীর্যপাতের কারনে উযূকে ফরজ করতাম। কেননা তা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। এবং পুরুষদেরকে মীরাস মহিলাদের অর্ধেক দিতাম। কেননা মহিলারা পুরুষদের চেয়ে দুর্বল” -মিরকাতুল মাফাতীহ  ২/৪৬০

তাই আমাদের এই ত্রুটিপূর্ণ বিবেক দ্বারা শরীয়াতের সকল হুকুম আহকামের রহস্য যেমনিভাবে উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয় তেমনিভাবে তা সমীচীনও নয়।

এরপরেও উল্লেখিত বিষয়টির যৌক্তিক ব্যাখ্যা এভাবে হতে পারে-

(১) বাহ্যিকভাবে বিষয়টি উল্টো মনে হয়। তাই আল্লাহ্‌ তাআলা দেখতে চান বান্দা যুক্তির পিছনে পড়ে নাকি হুকুমের উপর আমল করে।

(২) মূল্যমানের বিষয়টি বিবেচনায় না আনলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য কিন্তু পরিমানের দিক দিয়ে অনেক বেশী। সে তুলনায় সাত তোলা স্বর্ণ কিন্তু পরিমানের দিক দিয়ে কম। কাজেই কেউ যখন সাড়ে বায়ান্ন তোলা (যা পরিমানের দিক দিয়ে বেশী) এমন সম্পদ(রৌপ্য) জমা করেছে যা তার নিত্যপ্রয়োজনে ( ভরন-পোষণে) কাজে আসে না তখন তাতে গরীবের হক সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে কারো নিকট সাত তোলা সোনা থাকলে পরিমানের দিক দিয়ে তা কিন্তু খুব একটা বেশী না। যদিও তার মূল্য অনেক বেশী। অর্থাৎ ওজন ও পরিমানের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। সোনার মূল্য বেশী হবার কারনে নেসাব নির্ধারণে ওজনে কিছুটা কম করা হয়েছে। আর রূপার মূল্য কম হবার কারনে ওজনে কিছুটা বেশী করা হয়েছে।

সারকথা, যাকাতযোগ্য চারটি মালের প্রতিটির ক্ষেত্রে শরীয়াত একটি সীমা বা নেসাব নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা না হলে নয়। যেমন সোনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত তোলা, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা, উটের ক্ষেত্রে ৫টি, গরুর ক্ষেত্রে ৩০ টি এবং ছাগলের ক্ষেত্রে ৪০ টি। যা কারো আয়ত্তে এলে সে অধিক মালের মালিক বলে গণ্য হবে। এবং তাতে গরীবের হক সাব্যস্ত হবে।

যাই হোক, আসল যুক্তি তো আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। তার জ্ঞানই কেবল পরিপূর্ণ। আমার নিজের যা বুঝে এসেছে এখানে তাই বলেছি। কোন ভুল ত্রুটি হলে তা আমার প্রতিই সম্পৃক্ত হবে ইসলামী শরীয়াতের প্রতি নয়।

(খ) মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। আপনি বিষয়টিকে এভাবে বুঝুন। আপনি তিনজনের কাছে টাকা আমানত রাখলেন। একজনের কাছে দশ হাজার দ্বিতীয় জনের কাছে বিশ হাজার এবং তৃতীয় জনের নিকট ত্রিশ হাজার। এখন এক বছর পর যার নিকট দশ হাজার টাকা রেখেছিলেন তার নিকট যদি দুই শত পঞ্চাশ টাকা চান আর সে আপত্তি করে যে, যাদের নিকট বিশ ত্রিশ হাজার টাকা রেখেছেন তাদের কাছে এক টাকাও চাননি অথচ আমার নিকট মাত্র দশ হাজার টাকা রেখে আড়াই শত টাকা চাচ্ছেন? এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখবেন? এটা কি বেইনসাফী হবে?

আসলে আমাদের নিকট যে সম্পদ রয়েছে তার মালিকানা আল্লাহ্‌ তাআলারই। এজন্যই আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআন শরীফে মুমিনদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন “আমি তাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় (যাকাত,সদকাহ আদায়) করে”।–সূরা বাকারাহ, আয়াত ৩। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তাআলা একথা বুঝিয়ে দিলেন তোমরা যে যাকাত, ছদকাহ, ফেতরা ইত্যাদি আদায় করে থাক তা আমার দেওয়া সম্পদ থেকেই।তোমাদের সম্পদ থেকে নয়।কাজেই আমি যখন, যেভাবে, যে অবস্থায়, যে পদ্ধতিতে যাকাত আদায় করতে বলি সেভাবেই আদায় করবে।কারন আমার মালই তো ফেরত নিচ্ছি।

(গ) হ্যাঁ, এমন ঘটনা তো অসংখ্য। আমি বরং এমন ঘটনা উল্লেখ না করে সোনা রূপার নেসাব সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করছি। যেখানে সোনার নেসাব সাড়ে সাত তোলা এবং রূপার নেসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা বলা হয়েছে। আর এটা তো স্পষ্ট যে সাহাবায়ে কেরাম উক্ত নেসাবের মালিক হলে যাকাত আদায় করতেন। কাজেই নেসাব সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করলেই তা প্রিয় নবীর জীবদ্দশায় বেশি সম্পদের মালিক হয়েও যাকাত দেয়নি, আর অল্প সম্পদের মালিক হয়েও তার যাকাত দিতে হয়েছে এমন সকল ঘটনাকে শামিল করবে।

فهاتوا صدقة الرقة من كل أربعين درهما درهم وليس فى تسعين ومائة شىء فإذا بلغت مائتين ففيها خمسة دراهم

অর্থঃ তোমরা রূপার যাকাত আদায় করবে প্রত্যেক চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম। আর একশত নিরানব্বই দিরহামে কোন যাকাত নেই।যখন তা (দিরহাম) দুইশততে পৌঁছাবে তাতে পাঁচ দিরহাম যাকাত আসবে।– সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৫৭৬; সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ৬২০।

فإذا كانت لك مائتا درهم وحال عليها الحول ففيها خمسة دراهم وليس عليك شىء – يعنى فى الذهب – حتى يكون لك عشرون دينارا فإذا كان لك عشرون دينارا وحال عليها الحول ففيها نصف دينار

অর্থঃ যখন তোমার দুইশত দিরহাম হবে এবং তার উপর বছর পূরা হবে তখন তাতে পাঁচ দিরহাম যাকাত আসবে।স্বর্ণে তোমার উপর কোন যাকাত নেই যতক্ষণ না বিশ দীনার হয়। আর যখন বিশ দীনার হবে এবং তার উপর বছর পূরা হবে তখন তাতে অর্ধ দীনার যাকাত ফরজ হবে।–সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৫৭৫।

উপরোক্ত দুইটি হাদীসই সহীহ।

উল্লেখ্য যে, দুইশত দিরহামে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা হয় এবং বিশ দীনারে সাড়ে সাত তোলা সোনা হয়।

Loading